ads

শূন্যতার গান

 শূন্যতার গান


গ্রামের শেষ প্রান্তে তেঁতুলিয়া ডি. বি. উচ্চ  বিদ্যালয়ে পড়ত সৌরভ। তার বয়স ছিল পনেরো, এবং সে নবম শ্রেণির ছাত্র। সৌরভের জীবন সাধারণ ছিল, কিন্তু তার মনের গভীরে একটি অসাধারণ স্বপ্ন ছিল—একদিন সে একজন সফল লেখক হবে। প্রতিদিন বিকেলে স্কুলের পর সে খেলার মাঠের কোণে বসে নিজের চিন্তা ও কল্পনাকে কাগজে লেখার চেষ্টা করত।

সৌরভের পরিবারে তার মা, বাবা এবং ছোট একটি বোন ছিল। তার বাবার ছোট ব্যবসা, যা ভালো চলছিল না। সৌরভের মা সবসময় চেষ্টা করতেন সন্তানদের ভালো রাখতে। সৌরভ জানত, তার পরিবারের অবস্থার কারণে তার লেখার স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ ছিল।

একদিন, সৌরভ স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখল তার মা খুব চিন্তিত। তিনি বললেন, "বাবা, আমাদের জন্য কিছু নতুন ব্যবসার চিন্তা করতে হবে। আমাদের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ।" সৌরভ কিছু বলার সাহস করল না। সে বুঝতে পারল, তার মায়ের চিন্তা তার লেখার স্বপ্নকে চাপা দিচ্ছে।

কিছুদিন পর, স্কুলে একটি গল্প লেখার প্রতিযোগিতা ঘোষণা করা হলো। সৌরভ তাতে অংশগ্রহণ করতে চাইল, কিন্তু মনে মনে সে জানত যে পরিবারের পরিস্থিতির কারণে তার লেখালেখির জন্য সময় নেই। তবুও, তার হৃদয়ে একটি আশা জাগল—সাফল্য পেলে হয়তো পরিবারে কিছু পরিবর্তন আসবে।

সৌরভ এক রাতে লেখার জন্য বসে পড়ল। সে এক মিষ্টি কাহিনী লিখতে শুরু করল, যা তার নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি। তার লেখার বিষয় ছিল একটি স্বপ্ন, যা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে পরিবারের দুঃখের কারণে। সে লেখাটি শেষ করতে পারল, কিন্তু সকালে উঠে সে দেখল, তার বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

সৌরভের বাবা হাসপাতালে ভর্তি হলেন। চিকিৎসকেরা বললেন, তাকে দ্রুত অপারেশন করতে হবে। সৌরভের পরিবার তখন ভেঙে পড়ল। তাদের কাছে অর্থ ছিল না, এবং সৌরভের লেখার স্বপ্ন হঠাৎ করেই ধূলিসাৎ হয়ে গেল। সে বুঝতে পারল, এখন তার লেখার চেয়ে বাবার সুস্থতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

অবশেষে, সৌরভ এবং তার মা কিছু ঋণ নিলেন এবং বাবার চিকিৎসার জন্য অর্থ জোগাড় করলেন। চিকিৎসা সফল হলেও, সৌরভের বাবার স্বাস্থ্য আর আগে মতো ভালো হয়নি। তিনি কাজে যোগ দিতে পারলেন না, এবং পরিবারের চাপ আরো বেড়ে গেল। সৌরভ তখন লেখালেখির পরিবর্তে পার্শ্ববর্তী একটি দোকানে কাজ করতে শুরু করল। প্রতিদিন বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে দোকানে বসতে হত তাকে।

সৌরভের লেখালেখি বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু তার মনের মধ্যে গল্পগুলো ঘুরপাক খেতে লাগল। তার সব অনুভূতি, সব স্বপ্ন, সব আশা—সবই এক অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছিল। ক্লাসের বন্ধুদের কাছে সে গল্পের প্রতি আগ্রহী থাকলেও, নিজের গল্পগুলো আর সে শেয়ার করতে পারল না।

দিনগুলো গড়িয়ে গেল, সৌরভের ছোট বোন স্কুলে ভর্তি হলো। সে যখন লেখার বিষয়ে কথা বলত, সৌরভের মনে হতো, তার জীবনের স্বপ্নগুলো তাকে তাড়া করছে। একদিন, তার বোনের একটি প্রজেক্টের জন্য লেখার প্রয়োজন হল। সৌরভ সেদিন তার পুরনো খাতা বের করে দেখল। কিছু লেখা পড়ে মনে পড়ল তার সব স্বপ্ন। কিন্তু সে লিখতে পারেনি।

সৌরভের মনে হলো, তার সমস্ত সম্ভাবনা মরে গেছে। পরিবারে চলমান দুঃখ-দুর্দশা তাকে গ্রাস করছিল। একদিন, ক্লাসে প্রিয় শিক্ষিকা সৌরভকে ডাকলেন। তিনি বললেন, "সৌরভ, তোমার লেখা খুব সুন্দর। তোমার প্রতিভা রয়েছে। কেন লিখছ না?" সৌরভের চোখে জল এসে গেল। সে কিছু বলার সাহস করল না, শুধু মাথা নেড়ে সেখান থেকে চলে এলো।

এভাবেই দিনগুলো চলে গেল। সৌরভের লেখার স্বপ্ন একসময় কেবল একটি অশ্রুর স্মৃতি হয়ে রইলো। সে জানত, কিছু স্বপ্ন পূরণ হয় না। কিন্তু গভীরে, কোথাও একটি আশার দানাও ছিল—একদিন হয়তো সে আবার লিখতে শুরু করবে।





Tags

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.

#buttons=(Ok, Go it!) #days=(20)

Our website uses cookies to enhance your experience. Learn More
Ok, Go it!